রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের বিষয়ে দেওয়া জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটি।
সরকারের একজন মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন বলে এএফপির খবরে বলা হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এটি প্রথম প্রতিক্রিয়া।
রাষ্ট্র পরিচালিত পত্রিকা গ্লোবাল নিউজ লাইট অব মিয়ানমারের খবরে বলা হয়, সরকারের মুখপাত্র জ হতে বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনকে মিয়ানমারে ঢুকতে দিইনি। তাই মানবাধিকার পরিষদের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই এবং মানবাধিকার কাউন্সিলের সুপারিশ গ্রহণ করতে পারছি না।’
গত সোমবার জাতিসংঘের মিয়ানমার-বিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশন এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যা। এ জন্য মিয়ানমারের সেনারা সেখানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করেছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।রাখাইনে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে অন্তত ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করে। প্রতিবেদন তৈরিতে তারা ভিডিও ফুটেজ, স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করেছে।
২০১৬ সালের অক্টোবর আর ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের পর এই প্রথম জাতিসংঘের কোনো প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীকে গণহত্যার অভিযোগে কাঠগড়ায় নিতে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা বন্ধে সেনাবাহিনীর রাশ টানতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ব্যর্থ হয়েছেন, সেটাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
রাখাইনে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ওই তথ্যানুসন্ধানী মিশন গঠন করে। ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং শিশু ও সশস্ত্র সংঘাতবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ের রাধিকা কুমারাস্বামী ও অস্ট্রেলিয়ার মানবাধিকার পরামর্শক ক্রিস্টেফার সিডোটি।
প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র, ভিডিও, ছবি ও স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, গবেষক আর কূটনীতিকদের সঙ্গে অন্তত আড়াই শ বৈঠক করেছেন। কারও কারও লিখিত বক্তব্য নিয়েছেন। কারও কারও সঙ্গে কথা বলেছেন টেলিফোনে।
প্রতিবেদনে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ রাখাইনে অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ছাড়া পাঁচ জেনারেলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন উপসেনাপ্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সোয়ে উইন, বিশেষ অভিযান ব্যুরোর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিউ জ, পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল মং মং সোয়ে, ৩৩ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং এবং ৯৯ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান ও।
রাখাইনের পাশাপাশি শান ও কাচিন অঞ্চলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ভূমিকা রেখেছে।
২০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের জেনারেলদের তদন্ত করে ‘যথাযোগ্য’ আদালতে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করার মতো যথেষ্ট তথ্য পেয়েছে তথ্যানুসন্ধানী মিশন। রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, সেগুলোর মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যকে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।
মিয়ানমার সরকার বরাবরই বলেছে যে রাখাইন অঞ্চলকে জঙ্গিদের ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযান চালানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সামরিক প্রয়োজনে নির্বিচারে হত্যা, গণধর্ষণ, শিশুদের ওপর হামলা এবং পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু চৌকিতে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে। নির্বিচারে গ্রাম পোড়ানো, হত্যা আর ধর্ষণের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তারা। কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ঢলের পর থেকে এসেছে ৭ লাখ ২ হাজার। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরের কয়েক মাসে এসেছিল ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। অন্যরা আগে থেকেই অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন